আজ পবিত্র ফাতেহা-এ-ইয়াজদাহুম (বড়পীর সম্পর্কে জানুন)


আজ পবিত্র ফাতেহা-এ-ইয়াজদাহুম।আজকের এই দিনে বড় পীর হযরত মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (.) ইন্তেকাল করেন।৫৬১ হিজরীর ১১ রবিউস সানি আধ্যাত্মিক জগতের  মহান সাধক কোটি কোটি ভক্ত অনুরক্তকে শোক সাগরে ভাসিয়ে প্রভুর একান্ত সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। আমাদের এ উপমহাদেশের মুসলমানগণ বড় পীর সাহেবের স্মরণার্থে এই দিনে ফাতেহার মধ্যদিয়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলতার জীবনীআলোচনা এবং আল্লাহর দরবারে তার খাস মর্তাবা বৃদ্ধির জন্য দু  মুনাজাত করে থাকেন

হযরত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:

পীরাণে পীর দস্তগীর, মাহবুবে সোবহানী, কুতুবে রাব্বানী হযরত আবদুল কাদের জিলানী আল হাসানী ওয়াল হোছাইনী (রহঃ)-এর কুনিয়াত আবু মোহাম্মদ। মহিউদ্দিন তাঁর পবিত্র লক্বব বা উপাধি, জিলান নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে তাকে জিলানী বলা হয়। তার পবিত্র নাম আবু মুহাম্মদ মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী হলেও পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আশেকে আউলিয়াগণ তাকে বিভিন্ন গুণবাচক নামে আখ্যায়িত করে থাকেন। আমাদের এতদঞ্চলে তিনি গাউসুল আযম এবং বড়পীর নামেই প্রসিদ্ধ। গাউসুল আজম, বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)কে কুতুবে রাব্বানী এবং পীরাণে পীর দস্তগীর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এমনিভাবে তার আরও বহু গুণবাচক লক্বব বা উপাধি রয়েছে। হযরত গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকেই সাইয়্যেদ খানদান তথা রাসূলে পাক (দঃ)-এর পবিত্র বংশধারার সাথে সম্পর্কিত হযরত আবদুল কাদের জিলানী আল-হাসানী ওয়াল হোসাইনী (রহঃ)-এর পিতার নাম হযরত সাইয়্যেদ আবু ছালেহ মুসা জঙ্গী। তিনি একজন মহান অলি আল্লাহ ছিলেন। তার মাতার নাম ছিল হযরত উম্মুল খায়ের ফাতেমা। তিনি সে যুগের শ্রেষ্ঠ সুফী সাধক আবদুল্লাহ চাওমাঙ্গের অতি আদরের কন্যা ছিলেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)কে মাতা-পিতার দিক থেকে বংশপরম্পরায় সাইয়্যেদ কুলের শিরমনি হযরত ইমাম হাসান ওয়াল হুসাইনী বলা হয়।

পিতৃকুল : গাউসুল আজম, পীরাণে পীর দস্তগীর মাহবুবে ছোবহানী, কুতুবে রাব্বানী হযরত আবদুল কাদের জিলানী আল-হাসানী ওয়াল হোসাইনী (রহঃ) ইবনে সাইয়্যেদ আবু মুসা জঙ্গী ইবনে সাইয়্যেদ আবু আবদুল্লাহ আলজিবিল্লা (রহঃ) ইবনে সাইয়্যেদ ইয়াহ ইয়া যাহেদ (রহঃ) ইবনে সাইয়্যেদ মোহাম্মদ (রহঃ) ইবনে সাইয়্যেদ দাউদ (রহঃ) ইবনে আবদুল্লাহ সানী (রহঃ) ইবনে সাইয়্যেদ মুসাজুন (রহঃ) ইবনে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ আল মাহাস (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ হাসানুল মুসান্না (রাঃ) ইবনে আমিরুল মুমেনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু। অর্থাৎ হযরত গাউছে পাক (রহঃ) হযরত মাওলায়ে আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুরু ১১তম বংশধর।

মাতৃকুল : হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর মাতা হযরত সাইয়্যেদ উম্মুল খায়ের ফাতেমা বিনতে সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ ছাওমাদ যাহেদ (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ আবু জামাল (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ মোহাম্মদ ইবনে সাইয়্যেদ মাহমুদ (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ আবুল আতা আবদুল্লাহ ইবনে সাইয়্যেদ কামালুদ্দীন ঈসা (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ আবু আলাউদ্দিন (রাঃ) মোহাম্মদুল জাউয়াদ (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ আলীউর রেজা (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদ মুসা আল কাজেম (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদুনা আমিরুল মু, মেনীন হযরত হুসাইন (রাঃ) ইবনে সাইয়্যেদুনা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজ হাহুর অষ্টাদশ বংশধর।

শুভজন্ম : গাউসুল আযম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) ৪৭০ হিজরী মতান্তরে ৪৭১ হিজরী সনের পবিত্র রমজান মাসের পহেলা তারিখে জিলান শহরের সুবিখ্যাত সাইয়্যেদ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। 

বাল্যকালের একটি কাহিনী : শাবান মাসের শেষ দিন সন্ধ্যাবেলা আকাশে মাহে রমজানের চাঁদ উঠেছে কিনা দেখার জন্য সবাই ভিড় জমালেন। চাঁদ দেখে সকলে রোজা রাখবে কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেদিনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হওয়ার কারণে জিলান অধিবাসীরা কেউই চাঁদ দেখতে পারলেন না। পরের দিন রোজা রাখতে হবে কিনা এ নিয়ে জিলানবাসীরা হযরত গাউছে পাকের বাবা হযরত আবু ছালেহ মুসা জঙ্গী (রহঃ)-এর নিকটে এলেন কিন্তু এ সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। জিলানবাসীরা সবকথা হযরত গাউছে পাকের মাতা সাইয়্যেদা ফাতেমা (রহঃ)কে শুনালেন তিনি বললেন, চাঁদ দেখে রোজা রাখা উচিত। তবে আমার মনে হয় চাঁদ দেখা না গেলেও আজ পহেলা রমজান, জিলানবাসীরা অনেকেই তা কথা মেনে নিলেন না। তারা প্রশ্ন করলেন আপনি কীভাবে অনুধাবন করলেন যে আজ পহেলা রমজান, তিনি কিছু সময় ভাবার পর বললেন, আজ আমার শিশু সন্তান আবদুল কাদের সেহেরীর পর হতে আর দুধ পান করেনি। শুনলে আপনারা অবাক হবেন যে, মুখে কিছু দিলে ও সে খাচ্ছে না। তাই আমার মনে হয় সে রোজা রেখেছে। তার আচরণ থেকে বুঝা যায় যে, আজই প্রথম রোজা। সাইয়্যেদা ফাতেমার কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলেন, কেউ কোন প্রতিবাদ করলেন না। পরদিন অনেকেই রমজানের রোজা রাখলেন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) ছোটবেলা থেকেই একটু ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন। তিনি নিরিবিলি থাকা পছন্দ করতেন। মায়ের কোরআন তেলাওয়াত শুনেই তিনি আল-কোরআনের আঠারো পারা মুখস্থ করে ফেলেন। তিনি যে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হবেন জগৎ মাঝে যে তার সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে, ইতিহাসে যে তা সোনালি অক্ষরে তার নাম লিখা থাকবে, এসব আলামত তার শিশুকালেই প্রকাশ পেয়েছিল।

প্রাথমিক শিক্ষা : হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ)-এর পিতা তাকে জিলান নগরীর একটি মক্তবে বিদ্যাশিক্ষা করার জন্য ভর্তি করেন। ভর্তি করার পর ওস্তাদজী তাকে প্রথম থেকে পড়তে বললেন। তিনি সর্বপ্রথম আউযুবিল্লাহ এবং বিসমিল্লাহ পাঠ করলেন। অতঃপর আলিফ লামমীম হতে আরম্ভ করে কুরআনুল কারীমের আঠার পারার শেষ পর্যন্ত মুখস্থ পড়ে ফেললেন, শুধু মুখস্থ নয়, তারতীব ও তাজবীদসহকারে পড়েছিলেন। তার পড়া শুনে ওস্তাদজী অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কীভাবে কার নিকট হতে এত সুন্দরভাবে কোরআন পড়া শিখেছ এবং কীভাবে আঠার পারা কোরআন শরিফ মুখস্থ করেছ? ওস্তাদজীর কথার জবাবে তিনি বললেন, আমার মাতা আঠার পারা কোরআন শরিফের হাফেজ। তিনি তা প্রত্যহ তেলাওয়াত করে থাকেন। তার তেলাওয়াত শুনে আমারও মুখস্থ হয়ে গেছে। অল্প দিনের মধ্যে তিনি অনেক কিছু শিখে ফেললেন। ওস্তাদগণ তার মেধা দেখে বলতে লাগলেন, আবদুল কাদের ভবিষ্যতে নাম করা আলেম হবেন। মক্তবের শিক্ষা সমাপ্ত না হতেই তার পিতা দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। পিতার ইন্তেকালের পর থেকে সংসারের যাবতীয় ভার পরে হযরত গাউছে পাক (রহঃ)-এর ওপর। কিন্তু আল্লাহর অসীম রহমতে সাংসারিক ঝামেলার মধ্যেও তিনি বিদ্যা শিক্ষা চালিয়ে যান। সর্বদা তার খেয়াল ছিল কীভাবে জ্ঞান অর্জন করা যায়। হিজরি ৪৮৮ সালে ১৮ বৎসর বয়সে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক বাগদাদ নগরীতে পদার্পণ করেন। উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে হলে সে সময় বাগদাদে যেতে হতো। তিনি বাগদাদের বিশ্ব বিখ্যাত মাদ্রাসায়ে নিজামিয়াতে ভর্তি হলেন। তার ওস্তাদ ছিলেন সাহিত্য জগতের অন্যতম লেখক আবু যাকারিয়া তিবরিয়া। ইলমে ফেকাহ এবং উসুল শাস্ত্রের ওস্তাদ ছিলেন সেকালের নামকরা মুফতি শেখ আবুল ওফা আলী বিন আকির। হাদিস শাস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করেন শ্রেষ্ঠ হাদিসবিদ আবুল বরকাত তালহা আল আকুলীর নিকট। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) অল্প বয়সেই সুখ্যাতি নিয়ে নিযামিয়া মাদ্রাসার সর্বশ্রেষ্ঠ পরীক্ষা কামেল পাসের সনদ লাভ করেন। এ বিদ্যা শিক্ষাকালে তিনি অসীম কষ্ট সহিঞ্চুতার পরিচয় দিয়েছেন। সে সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন, আমার মনে যখন দুঃখ-কষ্ট বেশিরভাগ অনুভব হতো তখন আমি মাটিতে শুয়ে কোরআনের শাশ্বত বাণী ‘ইন্নমাল উসরি ইউসরা’ পড়তাম। তিনি নয় বছরে ১৩টি বিষয়ের ওপর সনদ লাভ করেন। হাদিস শাস্ত্রের সার্টিফিকেট দেয়ার সময় তার ওস্তাদ তাকে বললেন, হে আবদুল কাদির হাদিস শাস্ত্রে তোমাকে আমরা যে সনদ দিচ্ছি এটা একটা প্রচলিত নিয়ম মাত্র। তোমার মেধা এ দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কেননা হাদিসের অনেক ব্যাখ্যা আমরা বহু সময় তোমার সাথে আলোচনা করেই জানতে পেরেছি। হযরত আবুদল কাদের জিলানী (রহঃ) সর্বদা ভাবতেন, কীভাবে মহান আল্লাহর নিকট নৈকট্য লাভ করা যায়। তিনি অলি আবদালগণের সোহবতে কাটালেন অনেক দিন। দুনিয়ার সকল প্রকার আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে এমনকি মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য ও ব্যবহার্য দ্রব্যাদি ত্যাগ করে বনের ফলমূল ও শাকসবজি ইত্যাদি দ্বরা ক্ষুধা নিবারান করতে লাগলেন। মানুষের সাথে মেলামেশা বাদ দিয়ে নীরবে বসবাস করতে লাগলেন। প্রতি রাতে নফল নামাজে কোরআন শরিফ খতম করতেন। অনেক সময় জিকির ও ধ্যান করতে থাকতেন।
  
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) শুধুমাত্র ইলমে শরীয়ত ও মারেফতের পন্ডিত ছিলেন না। বরং তিনি কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি শাস্ত্রের সুপন্ডিত ছিলেন। তার প্রণীত কিতাবের মধ্যে ফতহুল গায়েব, গুনিয়াতুত তালেবীন, ফতহুল রাব্বানী, কাসীদায়ে গাউছিয়া সমধিক প্রসিদ্ধ। এ সকল কিতাবের বাংলা তরজামাও বের হয়েছে। যার ফলে অসংখ্য লোক সিরাতুল মুস্তাকিমের সঠিক সন্ধান পাচ্ছেন। হযরত বড়পীর (রহঃ)-এর গোটা জীবনের সাধনাই ছিল মানব কল্যাণ। মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। তিনি আজীবন শিক্ষকতা, ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে মানুষদের ইসলামের পথে আনার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠার সত্যিকার প্রশস্ত রাজপথ নির্মাণ করে গেছেন। যা বিশ্বের সকল মুসলমানদের পাথেয়।

ওফাতঃ হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ) হিজরি ৫৬১ সনের ১১ রবিউস সানী তার মাহবুবের নিকট গমণ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। ওরশ-ই-গাউসুল আজম তথা ফাতেহা-ই-ইয়াজদহম মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ। তার পবিত্র নূরানী দেহ মোবারক তারই আজীবনের কর্মক্ষেত্র দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায়ে কাদেরিয়ার সন্নিকটে শায়িত করা হয়।

Comments